শীতে পুলি পিঠে পায়েস ও নলেন গুরের মাহাত্ম

ব্রিটানের রানী এলিজাবেথ একবার সুস্বাদু নলেন (Nalen Gur) গুড়ের পাটালি (Date Palm Jaggery Brick) খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। শীত চলে এসেছে আর সঙ্গে বাঙালি বাড়ীতে পুলি পিঠা পায়েসের ধুম পরে গিয়েছে যার সঙ্গে নিবিড় ভাবে জুড়ে রয়েছে নলেন গুড়। 

এতে কোনো সংশয় নেই যে আজ বাংলার খেজুর (Khejur) রস থেকে গুড়, পাটালি, মিষ্টি, মোয়া, দই, কেক, আইসক্রিম ইত্যাদি একটি শিল্পের জায়গায় পৌঁছে গেছে। নলেন বা খেজুর গুড় মূলত ২ ধরণের পাওয়া যায় তরল যা ঝোলা গুড় এবং শক্ত বা পাটালি গুড়। ১০০ গ্রাম গুড় এর মধ্যে ৩৫৫ কিলো কালোরি এনার্জি থাকে যেখানে ৮৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ও ১. ৬৯ গ্রাম প্রোটিন বর্তমান।

Khejur Gurer Patali
আরও পড়ুন : পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন জেলার পর্যটন কেন্দ্র 

এই আর্টিকেল থেকে নলেন গুড় নিয়ে আমরা যে বিষয় গুলি জানতে পারবো 

- শিউলি বা গাছি 

- নলেন গুড়ের নামকরণ 

- নলেন গুড় উৎপাদনের সময় 

- প্রকৃতির মার ও উৎপাদনে ঘাটতি 

- খেজুর রস থেকে গুড় তৈরি করার পদ্ধতি 

- খেজুর / নলেন গুড়ের উপকারিতা

- যে স্থান গুলিতে ভালো মানের খেজুর গুড় পাওয়া যায় 

- নলেন গুড় ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট

- খেজুর ও নলেন গুড় থেকে তৈরি হওয়া খাবারের তালিকা 

- নলেন গুড় ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত কর্ম সংস্থান 

- নলেন গুড়ের ইতিহাস সাহিত্য ও সিনেমা 

- নলেন গুড়ের গান 

শিউলি বা গাছি 

খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও সেখান থেকে গুড় তৈরি করে মোটেও সহজ কাজ নয়। পৌষ মাঘ মাসের কোন কোনে ঠান্ডায় আমরা যখন লেপ মুড়ি দিয়ে আরামে ঘুমোই তখনি শুরু হয় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার কাজ। আর এই কাজ টি যারা করে থাকেন তাঁদের আমরা শিউলি (Siuli) বা গাছি (Gachi) বলে থাকি। যদিও অশ্বিন মাস থেকেই এই কর্মযোগ্য অর্থাৎ রস সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়ে যায়। সারা বছর অন্যান্য কাজ করে থাকলেও এই ছয় মাস শিউলিরা এই কাজেই মনোনিবেশ করে। যদিও এদের জীবন সংগ্রাম খুব কষ্টের এবং অনটনের। গাছি বা শিউলিরা যে সকলেই নিজের নিজের জায়গায় কাজ পান তা নয়, অনেকেই অন্য জেলায় গিয়ে কাজ করেন।

Juice collection from dates tree

নলেন গুড়ের নামকরণ 

রুক্ষ প্রান্তরে মূলত খেজুর গাছ পাওয়া যায়। যার যত গুলো গাছ আছে, শিউলিরা চেষ্টা করেন সেগুলো রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা। অশ্বিন কার্তিক মাসেই গাছের ওপরের অংশ চেঁছে ফেলা হয়। তারপর সেই অংশে নল ঢুকিয়ে মাটির কলসি বেঁধে দেয়া হয়। অনেকেরই ধারণা যে এই নল থেকেই নলেন গুড়ের নামকরণ।

আরও পড়ুন : পরীক্ষা বাজিমাত করার কৌশল 

নলেন গুড় উৎপাদনের সময় 

ডিসেম্বর থেকে ফ্রেব্রুয়ারী এই তিনমাস খেজুর গুড়ের প্রাকৃতিক যোগান, যার উপর নির্ভর করে বাংলায় কয়েকটি রাজ্যে তৈরি হয় নলেন ও পাটালি গুড়। উৎকৃষ্ট মানের রস আরও কম সময়ের জন্য পাওয়া যায় - ডিসেম্বর ১০ তারিখ থেকে এর পর মাত্র ৬০ দিন। 

Adv: Amazon Secret Deals, ভালো মানের প্রাকৃতিক গুড় এখানে পাওয়া যাচ্ছে 

প্রকৃতির মার ও উৎপাদনে ঘাটতি 

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়ার গতি ও শীতের মেয়াদ অনুযায়ী একটি গাছ থেকে দৈনিক প্রায় চার কেজি উৎকৃষ্ট মানের রস পাওয়া যেত। বর্তমানে সেই পরিমান আড়াই থেকে তিন কেজি তে ঠেকেছে। একটি খেজুর গাছ প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত রস উৎপাদন করতে সক্ষম।

খেজুর রস থেকে গুড় তৈরি করার পদ্ধতি 

যত শীত পরে রসের স্বাদ ততো ভালো হয়। একবার কাটার পর পরপর তিন দিন রস মেলে। প্রথম দিনের রসকে বলা হয় জিরেনকাট, যা সব থেকে সুস্বাদু। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের রস কে যথাক্রমে বলা হয় ডোকাট ও তেকাট। খুব ভোর থেকে এই রসকে জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর কাজ শুরু করতে হয়। এই কাজের জন্য শিউলিরা খেজুর গাছের কাছেই ফাকা মাঠে খেজুর পাতায় আগুন জ্বালিয়ে গুড় বানানোর কাজ করে থাকে।

Coocked Nalen Gur

খেজুর / নলেন গুড়ের উপকারিতা

- ওজন কমাতে সাহায্য করে।

- ঠান্ডায় কাশি সর্দি নিরাময় করে।

- হজম শক্তি বাড়িয়ে তোলে ও পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।

- খেজুর গুড় খেলে শরীরে আইরন এর ঘাটতি দূর হয়। 

- লিভার ভালো রাখে, শরীরকে শক্তিশালী ও সতেজ করে তোলে।

- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

- আজমা দূর করে।

- ত্বক কে ভালো রাখে।

যে স্থান গুলিতে ভালো মানের খেজুর গুড় পাওয়া যায়  

উত্তর দিনাজপুর জেলা :

দিনাজপুর জেলায় কুনোর গ্রাম, কালিয়াগঞ্জ ব্লকে আশ্রমপাড়া নামক একটি জায়গা আছে, যেখানে বংশ পরম্পরায় খেজুর গুড়ের ব্যবসা করে চলে আসছে অনেক পরিবার। এলাকায় পুরুষ সদস্যদের সাথে সাথে মহিলারাও এই ব্যাবসায় সহযোগিতা করেন। কুনোর গ্রামের  সুস্বাদু গুড়, পাটালি শুধুমাত্র পাশের জেলা নয় এমন কি কলকাতা ও সুদূর অন্য রাজ্যেও পৌঁছে যায়। 

জলপাইগুড়ি জেলা :

বর্তমানে উত্তর বঙ্গের কোনো অঞ্চলকে খেজুর গুড়ের জন্য দক্ষিণ বঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। গজলডোবায় নলেন গুড়ের ব্যবসা বেশ রমরমা। বহু পরিবার এই ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত। এখানকার গুড় পাশের জেলা নয় কলকাতা সহ অন্য রাজ্যেও পৌঁছে যাচ্ছে। 

আরও পড়ুন : কালিম্পঙ এর নিরিবিলি পর্যটন স্থল 

মালদা জেলা :

যাত্রাভাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েত এর দুর্গাপুর গ্রাম।

বামনগোলা, হবিবপুর এইসব ব্লকে প্রচুর খেজুর গাছ রয়েছে। 

এছাড়া রয়েছে দুই ২৪ পরগনা, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার বসিরহাট, মোছলন্দপুর, জয়নগর ও লালগোলা। 

নলেন গুড় ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট 

এক কেজি ভালো মানের গুড়ের জন্য ৭ থেকে ৮ কেজি রসের প্রয়োজন। বাজারে ভালো মানের গুড়ের দাম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। সুন্দর বন ও ২৪ পরগনা জেলার একটি সার্ভেতে জানা গিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে ধানের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ও অর্থকরী ফলের গাছ হল খেজুর। 


খেজুর ও নলেন গুড় থেকে তৈরি হওয়া খাবারের তালিকা 

গুড়ের সন্দেশ 

গুড়ের রাসাগোল্লা 

গুড়ের পায়েস 

গুড়ের মিষ্টি দই 

পিঠা, পুলি, পাটিসাপ্টা, লাড্ডু, কেক, মোয়া।

(খেজুর ও নলেন গুড়ের বিভিন্ন খাবার আমাজন বা ফ্লিপকার্ট থেকেও অনলাইন পাওয়া যাচ্ছে।)

বর্তমানে বিশেষ আকর্ষণ নলেন গুড়ের চা।

নলেন গুড় ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত কর্ম সংস্থান 

সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগে হাজারো ভেজাল থেকে আলাদা করে খাঁটি ও স্বাস্থ্য সম্মত খেজুর গুড় উৎপাদন করার জন্য শিউলি ও গাছি দের প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এর আওতাই ৪০০ থেকে ৫০০ জন ক্ষুদ্র চাষী ও খেজুর মালিকদের নিয়ে সমবায় পদ্ধতিতে গুড় তৈরি ও বিপননের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। 

দেখে নিন : শিলিগুড়ির খুব নিকটে পিকনিক স্পট 

নালেন গুড়ের ইতিহাস সাহিত্য ও সিনেমা 

ইতিহাসবিদ নিহার রঞ্জন রায়ের 'বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব ' থেকে জানা যায় ৮০০ বছর আগে 'সদুক্তিকণামৃত' তে নলেন গুড়ের ভুয়সী প্রশংসা রয়েছে। সত্তর দশকের অমিতাভ বচ্চন, নুতন, পদ্মা খান্না অভিনীত 'সৌদাগর' ছবি এখনো সকলের কাছে সমান ভাবে সমাদৃত, যা শিউলি দের জীবন জীবিকা নিয়ে চিত্রায়িত।

উপসংহার 

তাই পরিশেষে ভেজাল বা সস্তার গুড় থেকে বিরত থাকুন, ন্যায্য দামে খাঁটি খেজুর গুড়ের সন্ধানে থাকুন। আর খাঁটি গুড় চিনবেন কিভাবে? গুড় খাঁটি হলে হালকা চাপ দিলেই ভেঙে যাওয়ার কথা। আলতো করে আঙুলের চাপ দিলেই যদি গুড় ভেঙে যায়, তাহলে বুঝবেন সেই পাটালি গুড় খাঁটি। খেজুর গুড়ের গন্ধ আপনার মন জুড়িয়ে দেবে এটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি হলো গন্ধ শুঁকেই মজে গেলে হবে না। কারণ আসল গন্ধ না বুঝে কিনে ফেললে ঠকে যাওয়ার ভয় থাকতে পারে। অনেক সময় গুড়ের কৃত্রিম সুবাস আনার জন্য রাসায়নিক মেশানো হয়। তাই গন্ধ শুঁকেই সেই গুড় খাঁটি বলে ধরে নেবেন না।


আর শীত মানেই বাঙালির পুলি পিঠে, পাটিসাপ্টা, মালপোয়া, পায়েস আর মনের মধ্যে গান ধরা।

খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন

খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন,

ও নইলে রস গড়িয়ে,

নইলে রস গড়িয়ে গোড়া পচে 

অকালে হবে মরণ, 

খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন

খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন।

Post a Comment

Previous Post Next Post